২০১১ সালের শুরুর দিকে সূচিত হয় সিরিয়ায় বর্তমান চলমান বিধ্বংসী গৃহযুদ্ধের। তৎকালীন আরব বসন্তের প্রভাবে সিরিয়ার ক্ষমতাসীন বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে সিরিয় জনগণ বিক্ষোভ করলে, বিক্ষোভকে দমন করতে ক্ষমতাসীনদের অপ্রত্যাশিতভাবে শক্তি ব্যবহারের ফলে গৃহযুদ্ধের সূচনা ঘটে।

চলমান এই গৃহযুদ্ধে প্রাণ হারায় হাজার হাজার মানুষ। যুদ্ধের আট বছরে ৫৫ লক্ষের অধিক লোক গৃহহীন উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে ‘আরব বসন্ত’ বিপ্লবের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সিরিয়ার দেরা শহরের কিছু স্কুলছাত্র তাদের স্কুলের দেওয়ালে মজা করে

“হে ডাক্তার (বাশার আল-আসাদ), এবার তোমার পালা” লেখার পরই সমস্ত ঘটনার সূত্রপাত।

বেকারত্ব, দুর্নীতি এবং নিপীড়নের মধ্য দিয়ে একদলীয় শাসনের অধীন পঞ্চাশ বছর শাসনের প্রেক্ষিতে সিরীয় জনগণ দেশজুড়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।

বিক্ষোভ দমনে সিরীয় সরকার সশস্ত্র পন্থা গ্রহণ করলে নিরস্ত্র বিক্ষোভ সশস্ত্র গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়।

সিরিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধে সিরীয় সরকারকে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার, জনসাধারনকে ক্ষুধার্ত রাখা, নির্বাসন, অবরোধ, অবাধ গ্রেফতার ও নির্যাতনসহ বিভিন্ন প্রকার যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে।

সিরিয়ার গৃহহীন শরণার্থী:

আনাদোলু এজেন্সীর কাছে জমাকৃত তথ্যানুযায়ী, আট বছরের চলমান গৃহযুদ্ধে প্রায় ৫৭ লক্ষ বেসামরিক নাগরিক নিজেদের বসতবাড়ী হারিয়ে শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে।

এরমধ্যে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার তথ্যানুযায়ী, তুরস্কে মোট ৩৬,৪৪,০০০ জন সিরীয় শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে।

অন্যান্য দেশের মধ্যে ৯,৪৬,০০০ শরণার্থী লেবাননে এবং ৬,৭০,০০০ শরণার্থী জর্দানে আশ্রয় নিয়েছে।

এছাড়া ২,৫৩,০০০ শরণার্থী ইরাকে ও ১,৩৩,০০০ শরণার্থী মিসরে আশ্রয় নিয়েছে।

বর্তমানে সিরিয়ায় ২৯,৮০,০০০ বেসামরিক নাগরিক ঝুঁকিপূর্ণ বা অবরোধের অধীন অঞ্চলে বসবাস করছে।

ক্ষমতাসীনদের শোষণ ও নির্যাতন:

গত ১১ই মার্চের সিরিয়ান হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্কের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আসাদ সরকারের অধীন সিরিয়ায় কমপক্ষে ১,২৭,৯১৬ জন কারাবন্দী রয়েছে।

প্রতিবেদনটির তথ্যানুযায়ী, কারাগারে নির্যাতনের ফলে মোট ১৩,৯৮৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

ক্ষমতাসীনদের অবরোধের কারনে ৩৯৮টি শিশু ও ১৮৭ জন নারী সহ মোট ৯২১ জনের অনাহারে ও যথাযথ চিকিৎসার অভাবে মারা যাওয়ার কথা প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে।

ক্ষমতাসীন আসাদ সরকারের সেনাবাহিনী কমপক্ষে ২১৬ বারের মত রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

পাশাপাশি মার্কিন সমর্থনপুষ্ট পিকেকে/ওয়াইপিজে কর্তৃক ২,৭০৫ এবং উগ্রবাদী দায়েশ কর্তৃক আট হাজারের মত লোক অপহরন ও নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টিও প্রতিবেদনে এসেছে।

আঞ্চলিক দখলদারিত্ব:

আট বছরের যুদ্ধের পর বর্তমানে সিরিয়ার একনায়ক আসাদ সরকার তার গুরুত্বপূর্ণ দুই মিত্র রাশিয়া ও ইরানের সহায়তায় দেশটির ষাট শতাংশ ভূমি দখলে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।

সরকার বিরোধী বিদ্রোহীদের হাতে বর্তমানে সিরিয়ার দশ শতাংশ ভূমির উপর কর্তৃত্ব রয়েছে। এছাড়া ওয়াইপিজে ২৮ শতাংশ ও দায়েশ বর্তমানে সিরিয় ভূখন্ডের ২ শতাংশের উপর আধিপত্য বজায় রেখেছে।

ঘটনাক্রম:

১৫ই মার্চ, ২০১১: শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে দক্ষিনাঞ্চলীয় দেরা প্রদেশে একদল তরুন বিক্ষোভকারীর আসাদ সরকারের পতন দাবী করার মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় আরব বসন্ত বিপ্লবের সূচনা। বিক্ষোভ দ্রুতই সারাদেশে ছড়িয়ে পরে।

মার্চ-এপ্রিল, ২০১১: সিরিয়ার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ অব্যাহত, নিরাপত্তা বাহিনী ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ।

২৬শে এপ্রিল, ২০১১: বিক্ষোভ দমনে সেনা অভিযান, দেরা শহরে সেনাবাহিনীর প্রবেশ।

২৯শে জুলাই, ২০১১: দেইর আয-যর শহরে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি গঠন এবং সিরিয় সেনাবাহিনীর হামলার বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের সূচনা

৩০শে জুন, ২০১২: সিরীয় সংকট নিয়ে জেনেভায় বিভিন্ন পক্ষের আলোচনা

২১শে আগস্ট, ২০১৩: পূর্ব গাওতায় আসাদ বাহিনীর রাসায়নিক অস্ত্রের মাধ্যমে চৌদ্দশত বেসামরিক নাগরিকের প্রাণহরণ।

জানুয়ারী, ২০১৪: ইরানের সিরিয়ায় প্রবেশে, দায়েশের রাক্কা দখল।

৩০শে জুন, ২০১৪: দায়েশের খেলাফত ঘোষণা।

২২শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪: দায়েশের বিরুদ্ধে মার্কিন বিমান হামলা।

৩০শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫: গৃহযুদ্ধে রাশিয়ার সরাসরি প্রবেশ।

২৪শে আগস্ট, ১০১৬: দায়েশের বিরুদ্ধে তুর্কি সেনাবাহিনী ও ফ্রি সিরিয়ান আর্মির যৌথভাবে অপারেশন ইউফ্রেতিস শিল্ড অভিযান।

২২শে ডিসেম্বর, ২০১৬: ফ্রি সিরিয়ান আর্মির নিকট থেকে সিরীয় সেনাবাহিনীর আলেপ্পো দখল।

২৩-২৪ জানুয়ারী, ২০১৭: প্রথম আস্তানা বৈঠক।

৪ঠা এপ্রিল, ২০১৭: খান শাইকুনে সিরিয় বাহিনীর রাসায়নিক হামলায় শতাধিক বেসামরিক নাগরিক নিহত।

অক্টোবর, ২০১৭: ওয়াইপিজে’র দায়েশের নিকট থেকে রাক্কার দখল অধিকার।

জানুয়ারী, ২০১৮: তুরস্কের উত্তর সিরিয়ায় সন্ত্রাসবিরোধী অপারেশন অলিভ ব্রাঞ্চ।

১৪ই মার্চ-২৪শে এপ্রিল, ২০১৮: বিদ্রোহীদের গুরুত্বপূর্ণ পূর্ব গাওতার ঘাটি সিরীয় সরকারের দখল।

২১শে মে, ২০১৮: সম্পূর্ণ সরকারী নিয়ন্ত্রণে রাজধানী দামেস্ক।

১৭ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮: তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের মধ্যে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত ইদলিবকে যুদ্ধ-বিরতির আওতায় রাখার জন্য চুক্তি।

১২ই মার্চ, ২০১৯: ইদলিবে সিরিয় সেনাবাহিনীর রাসায়নিক হামলা।